কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, মোদী সরকারের তৃতীয় মেয়াদেই ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ কার্যকর করা হবে। তার একদিন পরই বড় পদক্ষেপ করল মোদী মন্ত্রিসভা। বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর), প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটির প্রস্তাব অনুমোদন করল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিসভার এই পদক্ষেপে ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ প্রস্তাব কার্যকর হওয়ার দিকে আরও এক কদম এগিয়ে গেল বলে মনে করা হচ্ছে। এরপর, রামনাথ কোবিন্দ কমিটির এই প্রস্তাবটি, সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে একটি বিল আকারে পেশ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে, সেই বিল পাশ করাতে মোদী সরকারকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতে পারে। লোকসভায় মোদী সরকারকে নির্ভর করতে হবে এনডিএ শরিক দলগুলির উপর। আর রাজ্যসভায় বিলটি পাশ করানোর জন্য এনডিএ-র বাইরে থেকেও সমর্থন জোগার করতে হবে। বিরোধী শিবির থেকে কিন্তু এই প্রস্তাবের বিরোধিতাই করা হয়েছে। কী এই এক দেশ এক নির্বাচন প্রস্তাব? কেন মোদী সরকার এই প্রস্তাব কার্যকর করতে চাইছে? বিরোধীরাই বা কেন এই প্রস্তাব মানতে চাইছে না? আসুন জেনে নেওয়া যাক –
‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ কী?
সোজা কথায়, এর অর্থ হল সমস্ত ভারতীয় লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে একসঙ্গে ভোট দেবেন। যদি একেবারে একই সময়ে নাও হয়, তাহলেও একই বছরের মধ্যে হবে লোকসভা এবং সকল বিধানসভাগুলির ভোট। বর্তমানে, দেশে নতুন কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচন করার সঙ্গে হাতে গোনা কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা ভোট হয়। এর মধ্যে আছে – অন্ধ্র প্রদেশ, সিকিম এবং ওড়িশা। গত এপ্রিল-মে মাসে যে লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল, তার সঙ্গে এই তিন রাজ্যেরও ভোট হয়েছে। চলতি বছরের শেষের দিকে ভোট দেবে হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডও। হরিয়ানার ভোট ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছে। দশ বছর পর বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে জম্মু ও কাশ্মীরেও। তবে, বাকি রাজ্যগুলির ভোট লোকসভা ভোটের সঙ্গে বা একই বছরে হয় না।
এক নির্বাচনে জোর মোদীর
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দীর্ঘদিন ধরেই “এক দেশ, এক নির্বাচন” চালু করার জন্য জোর দিচ্ছেন। ২০১৪ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ই তিনি এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে, বিজেপির ইস্তেহারেও এই ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বিরোধীদের কাছ থেকে প্রবল সমালোচনা আসে। যার জেরে সেই সময় এই পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আবার ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে এই নিয়ে চর্চা শুরু হয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দের নেতৃত্বে এক উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছিল মোদী সরকার। ৩৯টি রাজনৈতিক দল, অর্থনীতিবিদ এবং ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে এই কমিটি। বিশ্বের অন্যান্য দেশে কীভাবে একসঙ্গে নির্বাচন করা হয়, তাও খতিয়ে দেখে এই কমিটি। গত মাসে তার স্বাধীনতা দিবসের ভাষণেও, প্রধানমন্ত্রী মোদী গোটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ এক নির্বাচন চক্র গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
কীভাবে হবে ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’?
রামনাথ কোবিন্দের কমিটি সর্বসম্মতভাবে একযোগে নির্বাচন করার পক্ষেই মত দিয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,দুই ধাপে এই ব্যবস্থা কার্যকর করা যেতে পারে। প্রথমে একযোগে হবে লোকসভা এবং বিধানসভাগুলির নির্বাচন। তার ১০০ দিনের মধ্যে করা হবে স্থানীয় প্রশাসন, অর্থাৎ, দেশের সকল পৌরসভা এবং গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির নির্বাচন। তবে, এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন। সংসদ ও রাজ্য বিধানসভাগুলির মেয়াদ, লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভা ভেঙে দেওয়া এবং রাষ্ট্রপতির শাসন জারি সংক্রান্ত বিষয়গুলি সংশোধন করতে হবে। কমিটি জানিয়েছিল, শাসনব্যবস্থাকে ব্যাহত না করে নির্বাচনগুলিকে একত্রিত করার জন্য টেকসই আইনি ব্যবস্থা প্রয়োজন। মেয়াদ ফুরোনোর আগে, কোনও সরকারের বিলুপ্তির ঘটাতে হলে, সেই জায়গায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। অথবা সুসংগত নির্বাচন চক্রে সামিল করতে নির্বাচনের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদের সরকার গঠন করা যেতে পারে।
কেন ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ চায় মোদী সরকার?
মোদী সরকার ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ চাইছে মূলত সময়, অর্থ ও সম্পদ বাঁচানোর লক্ষ্যে। ঘন ঘন নির্বাচন হলে অনেক অর্থ খরচ হয়। তার পাশাপাশি, নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন কর্মী, নিরাপত্তা বাহিনী এবং অন্যান্য সংস্থান মোতায়েন করতে হয়। মোদী সরকারের যুক্তি হল, একসঙ্গে নির্বাচন করা হলে অর্থের পাশাপাশি এই মানব সম্পদ ও অন্যান্য সংস্থানও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যাবে। একযোগে নির্বাচন পরিচালনার ফলে সরকারের তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলিরও আর্থিক সাশ্রয় হতে পারে। অন্যথায় সারা বছর ধরে নির্বাচনের প্রচারে প্রচুর পরিমাণে খরচ হয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট বা আদর্শ নির্বাচনী বিধি। নির্বাচনের সময় এই বিধি জারি করে নির্বাচন কমিশন। যার ফলে সরকারের পক্ষে ওই সময় নতুন কোনও নীতি প্রবর্তন করা সম্ভব হয় না। ভারতে প্রতি বছর কোনও না কোনও রাজ্যে নির্বাচন হয়েই থাকে। তাই, আদর্শ নির্বাচনী বিধিও ঘন ঘন কার্যকর হয়। এতে সরকারি নীতির বাস্তবায়নে বাধা আসে। মোদী সরকারের দাবি, একযোগে নির্বাচনগুলি হয়ে গেলে আরও দক্ষতার সঙ্গে সরকার পরিচালনা করা সম্ভব হবে। নীতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে বাধা পেতে হবে না।
কোবিন্দ কমিটির রিপোর্টেও বলা হয়েছিল, একযোগে নির্বাচন হলে নির্বানের খরচ অনেকটা কমবে। প্রশাসনিক বোঝাও কমবে। আর এর পাশাপাশি, ভোটারদের সংখ্যাও বাড়বে। কমিটির মতে, বারবার ভোট হলে অনেক সময়ই ভোটাররা ভোট দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অনেকেই কাজের সূত্রে বাইরে থাকে। ভোট দিতে বাড়ি ফেরে তারা। বারবার ভোট হলে, তাদের পক্ষে বারবার কাজের জায়গা থেকে বাড়ি ফেরা সম্ভব হয় না। একসঙ্গে নির্বাচন হলে, তারা বাড়ি এসে একবারেই লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে নিজ নিজ নত প্রকাশ করতে পারবেন।
এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ এবং বিরোধীদের আপত্তি
প্রত্যেকটি বিষয়েরই কিছু ভাল দিক এবং কিছু খারাপ দিক থাকে। এক দেশ এক নির্বাচন প্রস্তাবের যেমন বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা রয়েছে, তেমন এটি কার্যকর করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বাধাও রয়েছে। আছে বিরোধীদের ওজর-আপত্তিও।
আগেই বলা হয়েছে, এটি কার্যকর করতে গেলে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। বিশেষ করে সংবিধানের ৮৩ এবং ১৭২ নম্বর অনুচ্ছেদ। এই দুই অনুচ্ছেদে সংসদ এবং রাজ্য বিধানসভাগুলির মেয়াদ কতদিনের হবে, তা বলা আছে।
এই প্রস্তাবের সমালোচকরা আরেকটি যুক্তিও দিয়েছে। তাদের দাবি, যদি রাজ্যর এবং দেশের নির্বাচন একইসঙ্গে করা হয়, তাহলে জাতীয় উদ্বেগের বিষয়গুলির আড়ালে চলে যেতে পারে আঞ্চলিক সমস্যাগুলি।
উপরন্তু, সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য অর্জন করাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং বিরোধী দলগুলি ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর এর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যদি কোনও রাজ্য বিধানসভার বা সংসদের পূর্ণ মেয়াদের আগেই বিলুপ্তি ঘটে, তাহলে সমস্ত নির্বাচনগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য নতুন করে সব রাজ্যেই নির্বাচন করতে হবে। অনেকের মতেই এটা অবাস্তব বিষয়।
আর্থিক এবং সংস্থানগত বাধাও রয়েছে বলে মনে করেন সমালোচকরা। উদাহরণস্বরূপ, একসঙ্গে ভোট করতে গেলে বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম প্রয়োজন। এছাড়া সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের খরচও অনেক।
ভারতে এক দেশ এক নির্বাচনের ইতিহাস
মজার বিষয়, স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েকটি লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে একযোগেই হয়েছিল, রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচন। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত একসঙ্গেই হয়েছে সকল নির্বাচন। তবে, ১৯৬৮ এবং ১৯৬৯ সালে কয়েকটি বিধানসভার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই বিলুপ্তির ঘটেছিল। তাই এরপর থেকে আর একযোগে নির্বাচন হয়নি।
বিশ্বে এক নির্বাচন
বিশ্বের অনেক দেশেই একযোগে নির্বাচন করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন, বেলজিয়ামের মতো বেশ কয়েকটি দেশে একইসঙ্গে জাতীয় ও রাজ্য নির্বাচন করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় যেমন ভোটাররা একইসঙ্গে জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক আইনসভার জন্য ভোট দেয়। এই রকম ছয়টি দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া অধ্যয়ন করেছে রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটিও।