এখন ভারতীয় ক্রিকেট মানে একটাই প্রশ্ন, বিরাট কোহলি প্রত্যেক ম্যাচে একই ভাবে আউট হবেন? সত্যিই তাই। এটাই ধারাবাহিকতা। বিরাট ব্যাট করতে নামা মানেই অফ স্টাম্পের বাইরে বল করতে হবে। কভার ড্রাইভেএকটি-দু’টি চার মারলেও ওই বলেই আউট হবেন বিরাট। তিনি নিশ্চয়ই খোঁচা দেবেন। ক্যাচ দেবেন উইকেটরক্ষক, স্লিপ বা গালিতে দাঁড়ানো ফিল্ডারের হাতে। এটাই ধারাবাহিকতা।
অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজ় মানেই ভারতে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে খেলা দেখতে বসা। গত দু’টি সিরিজ়ে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল ভারত। এ বারে পার্থে জেতার পর হ্যাটট্রিকের আশায় বুক বাঁধছিলেন সমর্থকেরা। কিন্তু অ্যাডিলেডে গোলাপি বলে ১০ উইকেট হার বুঝিয়ে দেয় গত দু’বার ভারত কী করেছিল ভেবে বসে থাকলে হবে না। এ বারে কী করতে পারবে সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে দিয়েছে। আর এই চিন্তার মূল কারণ অবশ্যই ভারতীয় দলের ব্যাটিং।
পার্থে জিতলেও প্রথম ইনিংসে ১৫০ রানে শেষ হয়ে গিয়েছিল ভারতের ইনিংস। অ্যাডিলেডে দুই ইনিংসেই ২০০ রানের কমে (১৮০ এবং ১৭৫) শেষ হয়ে গিয়েছিলেন রোহিত শর্মারা। তাই বাউন্স এবং গতিতে ভরা ব্রিসবেনের পিচে ঋষভ পন্থেরা কতটা স্বচ্ছন্দ হবেন তা নিয়ে আশঙ্কা ছিল। তা যে অহেতুক নয়, সেটা সোমবার সকালে প্রমাণ করে দিল ভারত। সমর্থকেরা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠলেও ভারতীয় ব্যাটিংয়ের ঘুম ভাঙছে না।
অস্ট্রেলিয়া যে পিচে ৪৪৫ রান তুলল, সেই ব্রিসবেনে খেলতে নেমে যশস্বী জয়সওয়াল ইনিংসের দ্বিতীয় বলে আউট হলেন। মিচেল স্টার্কের প্রথম বল যশস্বীর ব্যাটে খোঁচা লেগে চারে চলে গিয়েছিল গালি দিয়ে। দ্বিতীয় বলটিতে ভারতের তরুণ ওপেনার ফরওয়ার্ড শর্ট লেগে ক্যাচ তুলে দিলেন। এক প্রকার উইকেট ছুড়ে দিয়ে এলেন যশস্বী। শুভমন গিলের আউটের ক্ষেত্রে অবশ্যই বড় কৃতিত্ব মিচেল মার্শের। গালিতে যে ভাবে শরীর ছুড়ে ক্যাচ ধরলেন তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। কিন্তু তার আগে শুভমনকে বার বার অফ স্টাম্পের বাইরের বলে খেলার প্রলোভন দিচ্ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার পেসারেরা। সেই ফাঁদে পা দিয়েই ক্যাচ দিলেন শুভমন। আর বিরাটের তো সেই পুরনো রোগ। তরুণ বা অভিজ্ঞ পেসার— সকলেই জানেন ভারতের সেরা ব্যাটারের দুর্বল জায়গা কোনটা। পার্থে শতরান করা বিরাট বার বার অফ স্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা দিয়েই আউট হচ্ছেন। রানের ধারাবাহিকতা না থাকলেও আউট হওয়ার ধরনে অবশ্যই রয়েছে। সোমবার জস হেজ়লউডের বলে সেই ভাবেই আউট হলেন উইকেটরক্ষকের হাতে ক্যাচ দিয়ে। পন্থের আউট হওয়ার ধরনটাও এক। প্যাট কামিন্সের বল মিডল স্টাম্পে পড়ে একটু বাইরের দিকে যাচ্ছিল। পন্থ খোঁচা দিলেন সেই বলে। ক্যাচ নিলেন উইকেটরক্ষক অ্যালেক্স ক্যারে।
ভারতীয় ব্যাটারদের আউট হওয়ার ধরন দেখে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, দলে এক জন ব্যাটিং কোচের প্রয়োজন কি না। প্রধান কোচ গৌতম গম্ভীরের সাপোর্ট স্টাফে কোনও ব্যাটিং কোচ নেই। গম্ভীর নিজে ব্যাটার ছিলেন। তাঁর সহকারী কোচ হিসাবে রয়েছেন অভিষেক নায়ার। তিনিও ব্যাটার ছিলেন। কিন্তু তাঁরা কী আদৌ বিরাটদের মতো ব্যাটারদের সামলানোর যোগ্য? ভারতের ব্যাটিং দেখে সঞ্জয় মঞ্জরেকর লিখেছেন, “ভারতীয় দলের ব্যাটিং কোচের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে। এখনকার ভারতীয় ব্যাটারদের টেকনিক্যাল সমস্যা কেন এত দিনেও ঠিক হচ্ছে না?” মঞ্জরেকর হয়তো ভুলে গিয়েছেন ভারতীয় দলে কোনও ব্যাটিং কোচ নেই। হয়তো গম্ভীর ভেবেছেন তিনি থাকতে আলাদা করে ব্যাটিং কোচের প্রয়োজন নেই। যদিও রাহুল দ্রাবিড় কোচ থাকার সময় ব্যাটিং কোচ হিসাবে কাজ করেছেন বিক্রম রাঠৌর। গম্ভীর নিশ্চয়ই দ্রাবিড়ের থেকে বড় ব্যাটার ছিলেন না।
সমস্যা শুধু টেকনিক্যাল নয়, মানসিকও। সোমবার সকালে ভারতীয় দল যখন ফিল্ডিং করতে নামে, তখনই মাথায় ৪০০ রানের চাপ। যে দল শেষ চারটি ইনিংসের তিনটিতে ২০০ রান পার করতে পারেনি, তাদের জন্য ৪০০ রান তো পাহাড় অবশ্যই। সেটা বোঝা যাচ্ছিল শুভমনদের শরীরী ভাষায়। ধারাভাষ্যকারেরা বার বার সে কথা বলছিলেনও। ভারতীয় ব্যাটারেরা একের পর এক আউট হতে শুরু করতেই দীপ দাশগুপ্ত বললেন, “দিনের প্রথম এক ঘণ্টায় ভারতীয় দলের শরীরী ভাষা মনে করে দেখুন, কী প্রচণ্ড ম্লান ছিল সকলে। তখনই মনে হচ্ছিল এরা ব্যাট করতে নামলে কী হবে। আশঙ্কাই সত্যি হল। ব্যাট করার সময় দেখা গেল ম্লান ভারতীয় দলকে। কোনও এক জনের খেলা নয় এটা, গোটা দলটা ঝিমিয়ে রয়েছে। সবাই যেন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। খারাপ লাগছে মিডল অর্ডার ব্যাটারদের জন্য। বিরাট বা পন্থের কাজ নয় নতুন বলের বিরুদ্ধে খেলা। প্রতি ম্যাচে প্রথম ১০ ওভারের মধ্যে নামতে হলে তো মুশকিল। সেই কারণেই তো ওদের মিডল অর্ডার ব্যাটার বলা হয়। দলের ওপেনার এবং তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামা ক্রিকেটারদের তো বল ছাড়তে হবে। মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। শট খেলার সময় পরে অনেক পাওয়া যাবে।”
একই কথা বলছিলেন ভারতীয় দলের প্রাক্তন ব্যাটিং কোচ ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গার। যে সময় বিরাট রান পাচ্ছিলেন না, সেই সময় তাঁর কাছে গিয়ে অনুশীলন করেছিলেন। সেই বাঙ্গার দেখতে পাচ্ছেন বিরাটের কোথায় ভুল হচ্ছে। তিনি বলেন, “শট নির্বাচনে ভুল হচ্ছে বিরাটের। ও নিজেও হতাশ হবে এই শট খেলার জন্য। এই ধরনের বল ইনিংসের শুরুতে যে কোনও ব্যাটার খেলতে চাইবে। এমন একটা হাফ ভলি সহজেই ছেড়ে দিতে পারত বিরাট। ছেড়ে দিলে বাকি ইনিংসটা খেলতে পারত।” বাঙ্গার যা বললেন, তার অর্থ, অন্য কোনও ব্যাটার যে শট খেলে আউট হবে, বিরাটের মতো ব্যাটার কেন সেই ভুল করবেন?
সোমবার ৪৪৫ রান তুলে শেষ হয় অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস। সকাল থেকেই বার বার খেলার মাঝে বাধা হয় বৃষ্টি। বল হাতে যশপ্রীত বুমরা ছাড়া বাকি বোলারেরা ধারাবাহিক ভাবে উইকেট নিতে পারেননি। আকাশ দীপ ভাল বল করে রান আটকালেও দিনের শেষ উইকেটটি শুধু নিয়ে খুশি থাকতে হয়েছে। কিন্তু যে পিচে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারেরা সহজে রান করলেন। সোমবার অ্যালেক্স ক্যারে ৭০ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেদিলেন, সেখানে ভারতীয় ব্যাটারদের সমস্যাটা কোথায় হল? অস্ট্রেলিয়ার বোলারেরা মাত্র ১৭ ওভার বল করেছেন। তাতেই চার জন ব্যাটার সাজঘরে। আইপিএলে তাঁদের প্রত্যেকেই কোটি কোটি দাম পান। লাল বলের ক্রিকেটেও নিজেদের প্রমাণ করেই ভারতীয় দলের জার্সি পড়েছেন। কিন্তু অভাব ধারাবাহিকতায়। অভাব ইতিবাচক মানসিকতায়। সমস্যা হচ্ছে টেকনিক্যালে। ৫৮টি টেস্টে ন’টি শতরান করা কোচ গম্ভীর কি সেই সমস্যা দূর করতে পারবেন?